বিশ্ববিদ্যালয় :
উদ্ভব, বিকাশ ও বিউপনিবেশায়ন
লেখক: সৈয়দ নিজার
বিশ্ববিদ্যালয়
বিকাশ,উদ্ভব ও বিউপনিবেশায়ন
বইটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ। বইটি বিউপনিবেশিত
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ধিত রূপ। বইটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
সেই সাথে কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বহিরবিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখনো
পিছিয়ে ও এই সমস্যার সমাধানও আলোচনা করেছেন। সমাধানের এই পদ্ধতিকে বিউপনিবেশায়ন
বলা হচ্ছে। সর্বপরি বইটিতে উপমহাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে লিখা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণত দুই ধরনের, পাঠদানকেন্দ্রীক
ও গবেষণাকেন্দ্রীক। পাঠদানকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় 'প্রথম প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয় '। ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রথমে
পাঠদান কেন্দ্রিক ছিল। এগুলোতে সাধারণত আইন,ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসা, কলা এসব অনুষধ ছিল।ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় কোনো
না কোনো চার্চের আন্ডারে ছিল।এবং বর্তমানে
যেসব প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় আছে তা ও কোনো
না কোনো চার্চ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে
ছাত্ররা যা ইতালির বালোনিয়াতে অবস্থিত। বর্তমান নাম ইউনিভার্সিটি অব বলোনিয়া।এটি
চার্চের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো ফলে এর সনদ দেয়ার অধিকার ছিল না।ইউরোপের আরো কিছু
প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন, প্যারিস
বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়,
প্যালেনসিয়া
বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি কারই সনদ দেয়ার ক্ষমতা ছিল না শুরুতে। পরে এনলাইন্টমেন্টের
পর চার্চের ক্ষমতা লোপ পায় আর এসকল বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি প্রদানের ক্ষমতা পায়।
চার্চের অধিনে জ্ঞানগত কোনো স্বাধীনতা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন এমন কিছু অধ্যায়ন
করা যেত না যা চার্চ এর শিক্ষা ও রাজার বিরুদ্ধে যেত।এমনকি সমাবর্তনে আনুগত্যের
শপথ নিতে হত।চার্চের বিরুদ্ধে গেলে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হত।গ্যালিলিও ও
ব্রুনো এর অন্যতম উদাহরণ। এনলাইন্টমেন্টের ফলে পরিবর্তন আসতে থাকি আর ইউরোপের
বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে থাকে।
উনিশ শতকের
শুরুতে ইউরোপে গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে।এগুলোকে নতুন
প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয় বা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়। প্রথম গবেষণাকেন্দ্রিক
বিশ্ববিদ্যালয় হল জার্মানি 'বার্লিন
বিশ্ববিদ্যালয়',যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল
১৮০৮ সালের দিকে।এখানে শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠ গবেষক আর ছাত্রদের বলা হতো তরুণ গবেষক। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের
রুপকার বলা হয় দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ও ভাষাতাত্ত্বিক ভিলহান্ম হামবোল্ডট। কান্ট
জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারণার প্রবর্তক। কান্টের মতে জ্ঞান দুই ধরনের। প্রাক-সিদ্ধ( a
prior) ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান(a
posteriori)।অভিজ্ঞতা নির্ভর জ্ঞান
ইন্দ্রিয় নির্ভর তাই ভুল হতে পারে। কিন্তু প্রাক-সিদ্ধ জ্ঞান অভিজ্ঞতা নির্ভর নয়,
তাই এটি ভুল হবার
সম্ভাবনা নেই। কান্টের মতে প্রাক-সিদ্ধ সংশ্লেষণাত্মক জ্ঞান হল সার্বিক জ্ঞান।আর
বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত সার্বিক জ্ঞানের প্রচার কেন্দ্র। এই জ্ঞানের একমাত্র
মাধ্যম হল যুক্তিনির্ভর বুদ্ধি। সার্বিক জ্ঞান সমাজ,ধর্ম, প্রচলিত জ্ঞানের বিরুদ্ধে যেতে পারে।যুক্তিনির্ভর যে ফলাফল আসে তাই গ্রহণ করতে
হবে ধর্মের বিরুদ্ধে যায়। হামবোল্ডট জ্ঞানগত স্বাধীনতার ধরণা সামনে আনেন। তারমতে
শিক্ষকের সাথে সাথে ছাত্রদের ও পাঠক্রম বেছে নেয়ার স্বাধীনতা থাকতে হবে।তার মতে
একজন শিক্ষক উপদেষ্টা (supervisor)
এবং একজন ছাত্রক গবেষক।
হামবোল্ডটের প্রস্তাব সে সময় গৃহীত না হলেও পরবর্তীতে আমেরিকায় তা আইনের ভিত্তি
পায় এবং বিকাশ লাভ করে। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ চলার ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল
ছিল।অর্থনীতি সচল করতে যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে,
যার মধ্যে কৃষি ও প্রকৌশল
বিষয় অন্তর্ভুক্ত বাধ্যতামূলক ছিল। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ল্যান্ড- গ্রান্ট
বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়।কারণ এসব বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি খরচে চলত না। প্রতিটি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি বরাদ্দ ছিল,যার আয় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জোগাড় করা
হতো। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল ও কৃষি বিষয়ে গবেষণার যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে
যায়। এখান থেকে পরবর্তীতে গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ হয়।
ঔপনিবেশিক আমলে
ইংরেজরা দাপ্তরিক কাজে ইংরেজি ভাষা করে।তাদের প্রচুর জনবল দরকার হয়।ফলে জনবল জোগান
দিতে ইংরেজিরা প্রতিষ্ঠা করে অনেকগুলো কলেজ। এসব কলেজের মূল লক্ষ্যছিল ইংরেজি জানা
জনবল তৈরি করা। কিন্তু এসব কলেজের মান ভাল ছিল না, যেহেতু বেশিরভাগ কলেজ ব্যক্তিগত উদ্যোগে
পরিচালিত হতো। এ সমস্যা দূর করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় কলকাতা,মাদ্রাজ ও মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদান
বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। এরা শুধু পরীক্ষা নিতে পারতো।কিন্তু এতেও শিক্ষার মানের
উন্নতি হয়নি। উপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষের অবস্থা আমেরিকার মত ছিল। ব্রিটিশ সরকার
চাইলে আমেরিকার মত ল্যান্ড-গ্রান্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
করে কৃষির উন্নতি সাধন করতে পারতো।কিন্তু তাদের প্রয়োজন ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়।এর
ফলে উপনিবেশিক আমল থেকে এ অঞ্চলের মানুষের চিন্তা তৈরি হয় সরকারি চাকরির। পরীক্ষায় কোনোমতে পাশ করার
সংস্কৃতি এই অঞ্চলে শিক্ষার কোনো উন্নতি ঘটাতে পারেনি।ফলে লর্ড কার্জন সিধান্ত নেন
এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো পরিবর্তন আনার।ততোদিনে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
পাঠদান থেকে গবেষণাকেন্দ্রীক বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপান্তর হলেও,ব্রিটিশরা প্রতিষ্ঠা করে পাঠদানকেন্দ্রীক
মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়।এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনও কৃষিবিষয়ে পাঠদান হত না।পাঠদান
হতো দর্শন,ইংরেজি সাহিত্য ও
দর্শন। এখনো পর্যন্ত আমরা সেই মধ্যযুগীয় পাঠদানকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোতে
আছি।
পোস্ট-কলনিয়াল সময়ে
এসে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে শুধু
কাঠামোগত পরিবর্তন যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন এরসাথে প্রাক-ঔপনিবেশিক শিক্ষার সাথে
সম্পর্ক এবং জ্ঞানগত ও আইনগত স্বাধীনতা। প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়ে এই অঞ্চলে অনেক
প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্ণনা পাওয়া যায়। নালন্দা,সোমপুর ইত্যাদি বিহারে দর্শন, জ্যোতি বিজ্ঞান,যুক্তিবিদ্যা, গনিত চর্চা করা হতো।এসব প্রাচীন গবেষণার সাথে
বর্তমানের মেলবন্ধন প্রয়োজন। এছাড়া বর্তমান
বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানগত ও আইনগত
স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে আংশিক স্বাধীনতা থাকলেও,এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবৃত শিক্ষা যদি সমাজ,
রাষ্ট্র কিংবা ধর্মের
বিরুদ্ধে যায়, তবে সে শিক্ষক বা
শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন ঝামেলা মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।এর ফলে এখানে গবেষণার উৎসাহ
নেই।এসমস্যা দূর করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণামুখি হবে। সেই সাথে পশ্চিমা জ্ঞানকে
সার্বিক ও পরম সত্য এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে জ্ঞানতাত্ত্বিক স্বাধীনতা আনতে হবে।
~By Tasrif Ayaz Apurbo
No comments:
Post a Comment