Thursday, June 5, 2025

        বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভব, বিকাশ ও বিউপনিবেশায়ন

সৈয়দ নিজার

( ভাবাংশ )

বিশ্ববিদ্যালয় এর আবির্ভাব

কোন কিছুই হঠাৎ করে আবির্ভাব হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় ও তার ব্যাতিক্রম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবির্ভাব বলতে কবে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় (University) নাম টি ব্যবহার শুরু হয়েছে এমন টাও বলতে পারি।

বিশ্ববিদ্যালয় কি?:

                    বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটি মূলত এসেছে ইংরেজি  ‘University’ শব্দ থেকে। যেটি আবার আসে ল্যাটিন শব্দ ‘universitas’ থেকে, যার অর্থ ‘সমগ্র’, ‘যৌথ’ বা ‘একত্র’। যা আমাদের ত্যামন কোন সংজ্ঞা প্রদান করে না যা দ্বারা আমরা এর ব্যবহার বুঝতে পারি। কেননা, একই শব্দ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাবহ্রত হচ্ছে। যেমন : ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘ইউনিভারসিটি অফ লন্ডন’ অথবা ‘কিডস ইউনিভার্সিটি অফ স্কুল’। যেহেতু আভিধানিক অর্থ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এর অর্থ বোঝা যায় না, সেহেতু ইতিহাস থেকে দেখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে কি বোঝয়।

                    মধ্যযুগে ইউরোপে যখন নগর রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়, তখন  আইন ও বিচার কার্য পরিচালনার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন হয়, এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। প্রথম প্রতিষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি এর নাম ছিল ল্যটিনে ‘Universitas Bononiensis’ যার বর্তমান নাম  ‘University of Bononese’. যা ছিল চার্চ এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ।

                     বলনিয়া ছিল ছাত্রদের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীতে শিক্ষকেরা প্যারিস ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেন, যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নটরডেমের ক্ষমতা লোপ করা।

বিশ্ববিদ্যালয় এর বিবর্তন

বিশ্ববিদ্যালয় মূলত ২ প্রকার।

১) পাঠদান কেন্দ্রিক।

২) গবেষণা কেন্দ্রিক।

মধ্যযুগীইয় এবং প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ছিলো পাঠদান কেন্দ্রিক। কেননা সেগুলো নগর রাস্ট্র পরিচালনার জন্য দক্ষ শক্তি উৎপাদন এর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যা ছিলো অতীত আশ্রয়ই পাঠদান, জ্ঞান উৎপাদন এর কোন লক্ষ্যই ছিলো না। কিন্তু ১৯ শতকের গোড়ার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ইউরোপে গবেষণা কেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় এর আবির্ভাব হয়। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় হলো প্রথম গবেষণা কেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় এর আর্বিভাব, উদ্দেশ্য,রুপান্তর এবং প্রভাব

         আর্বিভাব:  

বাংলায় প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হয় ১৭৫৭ সালে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।যেখানে শুধু ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা নেওয়া হত। যা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেখানে কোন পাঠদান দেওয়া হত না। ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত পাজ্ঞাব বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ভারতীয় প্রথম ইউরোপীয় ধাচের পাঠদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটিশ সরকার ১৯০৪ সালে ভারতের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে পাঠদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় এ রুপান্তর করে।

         উদ্দেশ্য:

বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল কারণ ছিল দীর্ঘ সময় বাংলা শাসন নিশ্চিত করা। আরও কিছু উদ্দেশ্য ছিল তা নিচে বলা হল:

1.     ইংরেজি দাপ্তরিক ভাষা হওয়ার কারণে বাংলা থেকেই দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া।

2.     মনস্তাত্তিক ভাবে ভারতীয় উপমহাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করা।

3.     ইউরপীয়দের উপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়া।

এই সকল বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ছিল পাঠদান কেন্দ্রিক এবং চাকুরিজীবি তৈরী এর অন্যতম লক্ষ্য।

রুপান্তর:

         ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালইয় গুলোতে ত্যামন কোন পরিবর্তন আসেনি। ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাশ করা হয়। যেখানে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোয় যোগদানের অধিকার প্রদান করা হয়। যেটা মোটেও জ্ঞানজাগতিক স্বাধীনতা নয়।

প্রভাব:

         ঔপনিবেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। ব্রিটিশ সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেও, তার পাঠদানে স্থান পায়নি কৃষি বিদ্যা। যদিও এই ভূখন্ড ছিল কৃষিপ্রধান এবং ঔপনিবেশিক পর্বে খাদ্য সংকট ও দূর্ভিক্ষ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

          এছাড়াও তখনকার পাঠদান হিসেবে পড়ানো হত ইতিহাস, দর্শন এবং ইংরেজী সাহিত্য। এই ইউরোপ কেন্দ্রিক শিক্ষার কারণে এই অঞ্চলের শিক্ষিত মানুষের সংস্কৃতি ও রুচিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে, বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে লোকজ সংস্কৃতি থেকে। এর ফলে হয় জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচ্ছেদ। এ কারণে হয়ে ওঠেনি এ অঞ্চলের জ্ঞান চর্চা।

লেখকের প্রস্তাবনা:

1.     সর্বজনের জ্ঞান সর্বজনের জন্য।

2.     সার্বিক জ্ঞানের নামে পশ্চিমা জ্ঞানকান্ডের শিক্ষা নয়, বরং জ্ঞানতাত্ত্বিক বহুত্ববাদ চর্চা।

3.     বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ ভিত্তিক নয়, পদ্ধতি ভিত্তিক বিভাজন।

4.     তা আঞ্চলিক এবং জাতীয় বিষয়ে জ্ঞানকান্ড নির্মাণের মধ্য দেয়ে বৈশ্বিক হবে।

5.     শিক্ষার্থীর মূল ঊদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত জ্ঞান এর সঙ্কট চিহ্নায়ন এবং তা নিরশন করে নতুন জ্ঞানের ঊদ্ভাবন।

6.     শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক নয়, ঊত্তর সাধক ও পূর্ব সাধক সম্পর্ক।

7.     বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অধি-বিশ্ববিদ্যালয় রুপে কর্মতৎপরতা চালাবে, দেশের প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে গবেষণা এবং শিক্ষার অগ্রাধিকার নির্ধারণ করবে।

পর্যালচনা:

          এই বই এর আলোচনা থেকে একটা মৌলিক প্রশ্নের ঊত্তর আমরা পেয়ে যাই, সেটা হল আমাদের স্বাধীনতার এত পরেও আমাদের দেশের সার্বিক ঊন্নতি এত ধীর গতি অথবা নেই কেন?

          এর ঊত্তর এটা যে, এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যেখানে আমাদের আঞ্চলিক জনসাধারণের সমস্ত দূরুহ সমস্যা, গুরুতর প্রয়োজন, দেশের সার্বিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা নিয়ে কাজ করার কথা সেখানে আমরা ইউরোপীয় জ্ঞানচর্চা করি। এই জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচ্ছেদ হচ্ছে এই সমস্যার মূল অন্তরায়।

এছাড়াও এই ইউরপীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব আরও গভীর। এটাকে আমরা পরম সত্য হিসেবে বিশ্বাষ করি, যার কারণে এটাও যে ভূল হতে পারে তা বোধ্যগম্য হয় না। যার চরম পর্যায়ে এখন আমরা দেখতে পাই আমাদের সামাজিক, নৈতিক, মানসিক অত্যন্ত খাড়া ঊদ্ধৃমূখী অবক্ষয়।  

          এই সমস্যার সমাধানে সৈয়দ নিজার বিশ্ববিদ্যালয়ে্র বিঊপনিবেশায়ন প্রস্তাব রাখেন যার রুপরেখা ঊপরে দেওয়া হয়েছে।

          কিন্তু বইয়ের বিস্তারিত আলোচনায় তিনি এ বিশ্বাষ এর প্রতি আহ্ববান জানিয়েছেন যে পরম সত্য বলে কিছু নাই, সব কিছু সংবৃত সত্য এবং একে বিঊপনিবেশায়নের অপরিহার্য শর্ত হিসেবে উল্লেখ্য করেছেন। যেটা যেকোনো ধর্মীয় বিশ্বাষের সাথে সাংঘর্ষিক এবং যা বিজ্ঞান সমর্থিতও নয়।

          এছাড়াও তিনি জ্ঞানচর্চার পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়েছেন, তাও কিছুটা অযৌক্তিক। কেননা, ক্ষতিকর জ্ঞানচর্চার বিরুপ প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ। যার চর্চা না করাই কাম্য।


~By Md Siam Ali Shikder

No comments:

Post a Comment

          বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভব, বিকাশ ও বিউপনিবেশায়ন সৈয়দ নিজার ( ভাবাংশ ) বিশ্ববিদ্যালয় এর আবির্ভাব কোন কিছুই হঠাৎ করে আবির্ভাব হয় ন...